টাম্পাকো অগ্নিকান্ডের এক বছরেও ডিএনএ টেস্টের অপেক্ষায় মর্গে ৫ মরদেহ

0
943
Print Friendly, PDF & Email

ডেস্ক নিউজ : শিল্প নগরী টঙ্গীর বিসিক এলাকায় টাম্পাকো ফয়লস্ লিমিটেড কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের আজ এক বছর পূর্ণ হল।

গত এক বছর ধরে ডিএনএ টেস্টের অপেক্ষায় ৫ লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পড়ে রয়েছে। ঢামেক মর্গে ডিএনএ টেস্টের জন্য নেয়া টাম্পাকোর মোট ৯ লাশের মধ্যে ৪ লাশের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর গত ৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারি এই ৪ লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

গত বছর এই দিনে কারখানাটির গ্যাস লাইন লিংকেজ থেকে ভয়াবহ বিস্ফোরণে পুরো কারখানা অগ্নিকান্ডে পরিণত হয়।

এতে কারখানার ৫ তলা ভবনসহ অধিকাংশ অবকাঠামো ভেঙ্গে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। আগুনে পুড়ে ও ধ্বংসস্তুপের নিচে চাপা পড়ে নিহত হন ৪২ জন ও আহত হন প্রায় ৭৫ জন। আহতদের মধ্যে অনেকে আজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন।

কারখানা কর্তৃপক্ষ ও সরকারের তরফ থেকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হলেও শ্রমিক পরিবারগুলোর যে ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ হওয়ার মত নয়। তদুপরি লাশের পরিচয় সনাক্ত না হওয়ার অজুহাতে নিহত ৫ শ্রমিকের পরিবারগুলোকে ঘোষিত ক্ষতিপূরণের টাকা এখনো দেয়া হয়নি।

এদিকে দুর্ঘটনার এক বছরের মাথায় ধ্বংসস্তুপ অপসারণ করে টাম্পাকো আবারো উঠে দাঁড়াচ্ছে। গত ৯ আগস্ট নতুন ভবনের ভিত্তি প্রস্তর উদ্বোধন করা হয়েছে। রোববার থেকে নতুন ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হচ্ছে।

কারখানা সূত্রে জানা গেছে, তিন মাসের মধ্যে স্টিলের অবকাঠামো নির্মানের লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানকে এবং এবছরই পুনরায় উৎপাদনে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে কারখানা কর্তৃপক্ষের। দুর্ঘটনার পর গত এক বছর ধরে শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন দিয়ে যাচ্ছেন কারখানা কর্তৃপক্ষ।

টাম্পাকো কারখানা দুর্ঘটনায় নিহত প্রত্যেক শ্রমিকের ওয়ারিশকে শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে গত ৯ ফেব্রুয়ারি ৩ লাখ টাকা করে এবং আহতদের প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকার অনুদান দেয়া হয়। নিহত মোট ৪২ জনের মধ্যে ৩২ জনকে এবং আহতদের মধ্যে মোট ৪০ জনকে এ অনুদান দেয়া হয়েছে।

ডিএনএ টেস্টে লাশের পরিচয় সনাক্তসহ অন্যান্য প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়ায় বাকিরা এখনো ক্ষতিপূরণ পাননি।

এছাড়া কারখানা কর্তৃপক্ষ ক্ষতিপূরণ বাবদ শ্রম আদালতের মাধ্যমে প্রত্যেক নিহত শ্রমিকের জন্য আরো এক লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিচ্ছেন। ফলে নিহত প্রত্যেক শ্রমিকের পরিবার সর্বমোট ৪ লাখ টাকা করে পাচ্ছেন।

এছাড়া টঙ্গী বিসিক মালিক সমিতির পক্ষ থেকে নিহত প্রত্যেক শ্রমিকের পরিবারকে নগদ ২৭ হাজার টাকা এবং আহতদের প্রত্যেককে ১১ হাজার টাকা করে অনুদান দেয়া হয়েছে। এবং নিহত পথচারি পোশাক শ্রমিক আসমার পরিবারকে দেয়া হয় আরো নগদ ৫০ হাজার টাকা।

অপরদিকে গত বছর ১৯ সেপ্টেম্বর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে গাজীপুর জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে নিহত প্রত্যেক শ্রমিকের পরিবারকে নগদ ২০ হাজার টাকা এবং আহত প্রত্যেককে ১০ হাজার টাকা করে অনুদান দেয়া হয়েছে।

একই দিন স্থানীয় সংসদ সদস্য জাহিদ আহসান রাসেল নিখোঁজ শ্রমিকদের প্রত্যেকের পরিবারকে পাঁচ হাজার টাকা করে অনুদান দিয়েছেন।

দুর্ঘটনার পাঁচ মাস পর গত ফেব্রুয়ারি মাসে ডিএনএ টেস্টে পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর রফিকুল ইসলাম(৩৫), রিয়াজ হোসেন মুরাদ (২১), রেদওয়ান আহমেদ(৩২) ও আল-মামুন (৪০) এর লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এখনো নিখোঁজ বা মর্গে রয়েছে নাজিম উদ্দিন, মাসুদ আহমেদ, জহিরুল ইসলাম, আনিসুর রহমান ও জয়নুল ইসলাম এর লাশ।

এই দুর্ঘটনায় মালিক পক্ষকে দায়ী করে নিহত শ্রমিক জুয়েলের বাবা আব্দুল কাদের গত বছর ১২ সেপ্টেম্বর ও পুলিশের পক্ষ থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর পৃথক দুটি মামলা করা হয়।

এছাড়া গাজীপুর জেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস, শ্রম মন্ত্রণালয় ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশন (জামাক) পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করে।

“অপরদিকে ধ্বংসপ্রাপ্ত কারখানার তিন কোটি টাকার মালামাল চুরির অভিযোগে কারখানার পক্ষ থেকে আরো একটি পাল্টা মামলা করা হয়। এসব মামলা ও তদন্ত কমিটির একটিও এখনো কোন আলোর মুখ দেখেনি।”

দুর্ঘটনার পর দমকল বাহিনী ও গাজীপুর প্রশাসনকে সহায়তা করার জন্য গত বছর ১৩ সেপ্টেম্বর সেনাবাহিনী উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়। এর পর গত ১২ ফেব্রুয়ারি উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়। উদ্ধার অভিযানে সেনা সদস্যরা ১৪ হাজার ৭৯২ টন গার্বেজ ও ২৮৮২টি ড্রাম অপসারণ করে। ধ্বংস স্তুপে লাশের অনুসন্ধানে সেনা সদস্যরা ডগ স্কোয়ার্ডও ব্যবহার করেন।

উল্লে­খ্য, গাজীপুর মহানগরির টঙ্গী বিসিক শিল্প এলাকায় সিলেট-৬ (গোলাপগঞ্জ) আসনের সাবেক দুই বারের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ড. সৈয়দ মকবুল হোসেনের মালিকানাধীন টাম্পাকো ফয়েল কারখানায় গত বছর ১০ সেপ্টেম্বর সকালে বিস্ফোরণে আগুন ধরে যায়। এতে প্রতিষ্ঠানটির চারটি ভবনের তিনটি ধসে পড়ে। এই দুর্ঘটনায় ৪২ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন ৭৫ জন। নিখোঁজ ছিলেন মোট ৯ জন। পরে ডিএনএ টেস্টে ৪ জনের পরিচয় সনাক্ত হলে নিখোঁজের তালিকায় থাকেন আরো ৫ জন। পুড়ে যাওয়া লাশের অংশ বিশেষ পরীক্ষায় নিখোঁজ ওই ৫ জনের পরিচয় সনাক্ত হয়নি। ফলে পরীক্ষাগারে আরো নমুনা পাঠানো হয়েছে এবং আগামী এক মাসের মধ্যে ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট পাওয়া যাবে বলে টাম্পাকো দুর্ঘটনা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা টঙ্গী মডেল থানার ওসি (অপারেশন) আলমগীর হোসেন জানিয়েছেন।

দেশের প্যাকেজিং শিল্পের প্রথম কারখানা টিএফএল : দেশের প্যাকেজিং শিল্পের প্রথম কারখানা টাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেড (টিএফএল)। টাম্পাকো ১৯৭৮ সালে যাত্রা শুরু করে। ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ লিমিটেড এবং সুইজারল্যান্ডের নেসলে বাংলাদেশ লিমিটেড কারখানার পণ্যের মোড়ক সরবরাহ করে টাম্পাকো।

এছাড়া আবুল খায়ের গ্রুপ, আকিজ গ্রুপ, প্রাণ গ্রুপ, ইস্পাহানী, কোকোলা ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেড, বিডি ফুডস লিমিটেড, অ্যাসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড, মেরিডিয়ান ফুডস লিমিটেড, ফু-ওয়াং ফুডস লিমিটেড, ইউনিভার্সাল ফুডস লিমিটেড, আবদুল মোনেম লিমিটেড, বাংলা-জার্মান লেটেক্য কোং লিমিটেড, শাহ ডেইরি ফুডস লিমিটেড,মোল্লা সল্ট (ট্রিপল রিফাইন্ড) ইন্ডাস্ট্রিজ লিঃ, ভিটালাক ডেইরি অ্যান্ড ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, প্রিন্স ফুডস লিমিটেড, হক বিস্কিট এন্ড ব্রেড ফ্যাক্টরী লিঃ, জনতা বিস্কিট এন্ড ব্রেড ফ্যাক্টরী লিঃ, এ.টি.এন ফুড এন্ড কনজ্যুমার প্রোডাক্টস লিমিটেড, প্রোম কনজিউমার্স প্রোডাক্টস প্রাইভেট লিমিটেড, আল-কাদ ল্যাবরেটরিস লিমিটেড, নুট্রিয়ন ফুডস লিমিটেড, নূর ফুডস লিমিটেড, গ্লোব বিস্কিট এন্ড ডেইরি মিল্ক লিমিটেড, নাবিস্কো বিস্কিট এন্ড ব্রেড ফ্যাক্টরী লিঃ, সিদ্দিক ফুড এন্ড অ্যাগরুবেজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, আফতাব ফুডস লিমিটেড, দ্যা লালমাই লিমিটেড, আল-আমিন সুইটস, ক্রেকাস লিমিটেড এর কার্যাদেশ সরবরাহ করে টিএফএল। এই তালিকা দৈনন্দিন বাড়ছে বলে কোম্পানিটি তাদের ওয়েব সাইডে প্রকাশ করেছে।

টিএফএল বিশ্বমানের সর্বশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করে খাদ্য ও পানীয়জাত পন্যের ফ্লেক্রিবল মোড়ক প্রস্তুত করে থাকে।

এছাড়া টিএফএল দেশে তামাকজাত পণ্যের (বেনসন, গোল্ডলিফ সিগারেটসহ) একমাত্র মোড়ক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান। এছাড়া টাম্পাকোতে সকল প্রকার পেপার ব্যাকড অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল, কর্ক টিপিং পেপার, প্লাগ রেপ (মোড়ানো) পেপার, প্রি-প্রিন্টেড টিপিং পেপার, ইনার ফ্রেম বোর্ড ইত্যাদি সব ধরণের পেপার তৈরি করা হত। এছাড়া এখানে সর্বশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করে সব ধরণের ফ্লেক্রিবল প্যাকেজিং কাজ করা হত। দেশের গর্বিত এই শিল্প প্রতিষ্ঠানটি নিমিষে ধ্বংস স্তুপে পরিণত হওয়াকে সহজে কেউ মেনে নিতে পারছেন না। দুর্ঘটনায় টিএফএল এর শ্রমিক-কর্মচারী ও তাদের পরিবার পরিজনের মধ্যে এখনো চরম হতাশা বিরাজ করছে।

শ্রমিক-কর্মচারিরা জানান, কখনো তাদের বেতন ভাতা বকেয়া রাখা হয়নি। প্রতি মাসের এক তারিখের মধ্যে তাদের বেতন পরিশোধ করা হতো। কারখানা কর্তৃপক্ষ শ্রমিক-কর্মচারিদের ছেলে মেয়েদের কারখানার পাশে শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ে ফ্রি পড়ালেখার ব্যবস্থা করেছে। এছাড়া সিলেটের গোলাপগঞ্জে ড. সৈয়দ মকবুল হোসেন উচ্চ বিদ্যালয়, সাজেদা পারভীন হোসেন উচ্চ বিদ্যালয়, সৈয়দ তানভীর হোসেন একাডেমি. সৈয়দা আবেদা হোসেন উচ্চ বিদ্যালয়,সৈয়দা ফারহানা হোসেন উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ছাড়াও অরো অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবদান রয়েছে টিএফএল এর।

শেয়ার করুন