মোশারফ হোসাইন তযু-নিজস্ব প্রতিবেদক : দো’চালা টিনশেড ঘর। ভেতরে ছড়ানো ছিটানো সিলভার তার,ববিন,বিভিন্ন নদী পথের ম্যাপ আর লঞ্চ,স্টীমার,কার্গো ও অন্যান্য নৌযানের ছবি। ঘরে ঢুকা মাত্রই যে কেউ বুঝতে পারবে এটা হয়তো গবেষণাঘার। অবশ্য প্রথম প্রথম একটু অবাগই হবেন গ্রামের একজন কৃষকের ঘরের এ দৃশ্য দেখে। তার নাম মো: রফিকুল ইসলাম। বয়স ৪৪। পেশায় কৃষক। আবিষ্কারের নেশায় বিভোর। চোখের সামনে ট্রলার ডুবিতে বহু মানুষের ভয়াবহ মৃত্যুর দৃশ্য দেখে ডুবে যাওয়া নৌযান সনাক্তকরণ যন্ত্র আবিষ্কারের ধারণা আসে মাথায়। সেই থেকে শুরু। ২৯ বছরের নিরব সাধনায় আবিষ্কার করেছেন ডুবে যাওয়া নৌযান সনাক্তকরণ প্রযুক্তি।
গভীর নদীতে কোন নৌযান ডুবে গেলে তার আবিষ্কৃত ওই যন্ত্রের সাহায্যে নৌযানটি খুব সহজে খুঁজে বের ও উদ্ধার কাজে বিশেষ সহযোগীতা করবে । গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলা লবণদাহ নদী ঘেষা মাওনা দক্ষিণপাড়া গ্রামে রফিকুল ইসলামের জম্ম। ছয় ভাই বোনের মধ্যে রফিকুল চতুর্থ। বাল্যকালে দূরন্তপনায় পেয়েছিল মারু উপাধি। বাবা ইসমাইল হোসেন মোড়ল ছিলেন ধানবীর লোক। বাবার স্বপ্ন ছিল ছেলে অনেক বড় ডাক্তার হবে। মানুষের সেবা করবে। সে স্বপ্ন নিয়েই মাওনা জে.এম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করান। কিন্তু বাবার স্বপ্ন পূরণ করা হলো না রফিকের। আবিষ্কারের নেশা তাকে স্কুল থেকে দূরে নিয়ে আসে। মাওনা বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতেই তার শিক্ষা জীবনের সমাপ্তি ঘটে। পড়াশোনায় বেশি দূর এগোতে না পারলেও নতুন কিছু একটা আবিষ্কারের জন্য তিনি সাধনা করছেন বহুকাল ধরেই। তার এ আবিষ্কার কেড়ে নিয়েছে ভালোবেসে বিয়ে করা বউ আর সংসার কে। ডুবে যাওয়া নৌযান সনাক্তকরণ যন্ত্র আবিষ্কারের জন্য ছুটেছেন দেশে দেশে। সংসার আর প্রিয়তমা স্ত্রী কে ভুলে বছরের পর বছর নদী আর জাহাজে সময় কাটিয়েছেন। এসব অপরাধ এনে এক সময় সংসার ফাকি দিয়েছে রফিকের জীবন থেকে। সব কিছুর পরও রফিক আশা ছাড়েনি। উদ্দেশ্য যে করেই হোক নৌযান সনাক্তকরণ যন্ত্র আবিষ্কার করতেই হবে। নিজ হাতে তৈরি করেছে বিশাল এক নৌযান পা-লিপি। এখানেই রফিক থেমে থাকেন নি দেশের কোথাও নৌযান দুর্ঘটনার সংবাদ পাওয়া মাত্রই তিনি চলে গেছেন সেখানে। নিজ উদ্যোগে সহযোগীতা করেছেন। বহু আগে থেকেই তার এ কাজে এলাকার মানুষ তাকে নৌ বিজ্ঞানী বলে জানেন।
সিলভার তার আর ববিন দিয়ে এই যন্ত্রটি তৈরি করতে সর্বোচ্চ ৫/১০ হাজার টাকা খরচ হবে বলে জানান তিনি। নৌযানের উপরিভাগে সিলভারের তৈরি একটি বল রাখতে হবে এবং নিচে তার রাখার জন্য বিশেষ ধরণের একটি বক্স থাকবে। নৌযানটি দুর্ঘটনায় পতিত হলে সিলভারের তৈরি ওই বলটি পানিতে ভেসে উঠবে। নদীর তলেদেশের যেখানেই নৌযান থাকবে বলটিও সেখানেই ভাসমান অবস্থায় থাকবে। যন্ত্রটির আবিষ্কারক রফিক আরো জানান, তার তৈরিকৃত যন্ত্রটি যদি আগে থেকে নৌযানে স্থাপন করে রাখা হয় তাহলে অতি দ্রুত ও সহজে দুর্ঘটনার স্থানে সুনির্দিষ্টভাবে নৌযান খোঁজে বের করে আনা সম্ভব। এটি দিয়ে পানিতে চলাচলকারী সব ধরনের নৌকা, লঞ্চ, স্টীমার, কার্গো ও অন্যান্য সকল নৌযান সনাক্ত করা যাবে। দুর্ঘটনায় কোন নৌযান অর্ধেক ডুবা মাত্রই বলটি নিজস্ব কৌশলে পানিতে ভেসে উঠবে। যদি কোন কারনে বলটির ভেতর পানি ঢুকে যায় তাহলেও বলটি পানিতে ভাসমান থাকবে। বলটি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে সিলভার, স্টীল, বিয়ারিং, কর্কসিট, এস.এস তার, এম.এস তার, ক্রেনের মোটা তার ও অন্যান্য ক্ষুদ্র যন্ত্রপাতি।
একই গ্রামের মৃত নুরুল ইসলাম (মেম্বার) এর ছেলে বিশিষ্ট সমাজ সেবক তরিকুল ইসলাম রিপন বলেন, বহুদিন যাবৎ দেখছি বিভিন্ন যন্ত্রপাতি নিয়ে রফিক মামা কাজ করছে। আশে পাশে কোথায় নৌ দুর্ঘনা ঘটলে ওনি নিজ দায়িত্বে সেখানে গিয়ে উদ্ধার কাজে সহযোগীতা করে। দীর্ঘদিন মাওয়া ফেরিঘাট ও পরে চট্রগ্রাম স্টিল ব্রিজ ডক ইয়াডে কাজ করেছেন তিনি। বর্তমানে এই আবিষ্কারক বৃদ্ধা মাতা সারবানু কে নিয়ে তার নিজ বাড়িতে বাস করছেন।
রফিকুল ইসলাম বলেন, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং দৈনিক বাংলাদেশ টুডের চেয়ারম্যান জোবায়ের আলম স্যারের সাথে আমার আবিস্কৃত যন্ত্র নিয়ে সাক্ষাৎ হয়েছে । তিনি আমাকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার উৎসাহ যোগিয়েছেন। সবার সহযোগীতা পেলে আমার আবিষ্কৃত যন্ত্রটি বিশ্ব সমাদৃত করবো। আমি চাই আমার আবিষ্কার বিশ্ববাসী কাজে লাগাক। আমার এ আবিষ্কার আনুষ্ঠানিক ভাবে সরকারের হাতে তুলে দিতে চাই।
ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ডুয়েট) যন্ত্র প্রকৌশল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী বলেন, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা আর আধুনিক কিছু প্রযুক্তির সমন্বয় করলে এই প্রযুক্তি খুব সহজে ডুবে যাওয়া নৌযান সনাক্ত করতে ভূমিকা রাখবে।