ডেস্ক নিউজ : দীর্ঘদিন পর জনসভায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, যারা সামান্য স্থানীয় সরকার নির্বাচনেই ভোট চুরি করে জিততে চায় তাদের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের মতো বৃহৎ দায়িত্ব কোনভাবেই নিরপেক্ষ হতে পারে না। শেখ হাসিনার অধীনে কোন সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না মন্তব্য করে তিনি বলেন, তার অধীনে তো নির্বাচন হবেই না। দলীয় সরকারের অধীনে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না জানিয়ে তিনি অবিলম্বে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দেয়ার দাবি জানান। আওয়ামী লীগের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে তিনি বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন দিয়ে নিজেদের জনপ্রিয়তা যাচাই করুন। নির্বাচনে তিনি ইভিএম বাতিল ও সেনা মোতায়েনের দাবি জানান।
গতকাল বিকেলে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন। প্রায় দেড় বছর পর রাজধানীতে খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে বিএনপি বড় পরিসরে এই সমাবেশ করে। বিএনপির সমাবেশে যোগ দিতে সকাল থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ ঢাকায় আসা শুরু করে। তবে বিএনপির অভিযোগ, এই সমাবেশে জনসমাগম ঠেকাতে বিভিন্ন জেলা থেকে সরকার পরিকল্পিতভাবে বাস চলাচল বন্ধ করেছে। ঘণ্টাব্যাপী বক্তব্যে খালেদা জিয়া এক ঘণ্টার বক্তব্যে সরকারের নানা সমালোচনা, অত্যাচার-নির্যাতনের অভিযোগ, দুর্নীতি, আগামীতে ক্ষমতায় গেলে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনসহ নানা প্রতিশ্রুতি দেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। দুপুর ২টায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সভাপতিত্বে জনসভা শুরুর এক ঘণ্টা পর খালেদা জিয়া সমাবেশস্থলে পৌঁছান। এ সময় চারদিক থেকে তার নামে স্লোগান ওঠে। তিনি হাত উঁচিয়ে নেতাকর্মীদের শুভেচ্ছার জবাব দেন। জনসভার জন্য উদ্যানে ৬০ ফুট লম্বা ও ৩০ ফুট প্রশস্ত মঞ্চ নির্মাণ করে বিএনপি। মঞ্চের চারপাশে বসানো হয়ে সিসি টিভি ক্যামেরা। মঞ্চের সামনে ৩০ ফুট জায়গায় বেষ্টনী দেয়া হয়। জনসভা ঘিরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আশপাশের এলাকা সাজানো ছিল নানা রঙের ব্যানার-ফেস্টুনে। এই সমাবেশ করতে ঢাকা মহানগর পুলিশ ২৩টি শর্ত দিয়েছিল বিএনপিকে।
সমাবেশে সরকারের সমালোচনা করে খালেদা জিয়া বলেন, তারা যে এত ছোট মনের, আজকে দ্বিতীয় দিনের মতো প্রমাণ করে দিয়েছে। এত ছোট মন নিয়ে রাজনীতি করা যায় না। এরা মানুষকে ভয় পায়। এজন্য ৭ নভেম্বর আমাদের জনসভা করতে না দিয়ে ৫ দিন পরে সমাবেশের অনুমতি দিয়েছে। গণপরিবহন বন্ধ করে দিয়েছে। এরা ক্ষমতায় থেকে জনগণকে যেমন ভয় পাচ্ছে, তেমনি বিভিন্ন দল বিশেষ করে বিএনপিকে ভয় পায়। যার কারণে আজকের সমাবেশে আসা নেতাকর্মীদের বিভিন্ন জায়গায় বাধা দিয়েছে। তিনি বলেন, বাইরের জেলার মানুষ যেন না আসতে পারে। রাজধানীর হোটেলগুলোতে অভিযান চালিয়েছে। অনেক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে। তিনি আরও বলেন, এমনকি আমিও যেন সমাবেশে আসতে না পারি সেই ব্যবস্থাও করেছে। আমি বাসা থেকে বের হয়ে দেখি রাস্তায় খালি বাস রেখে দিয়েছে। তিনি বলেন, আমরা সহিংসতার রাজনীতি করি না। আমরা আপনাদের শুদ্ধ করব। আপনারা যে মানুষ মারেন, গুম, খুন করেন এগুলো বাদ দিয়ে আপনাদের শুদ্ধ বানাব।
সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি
বক্তব্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনারদের উদ্দেশে বিএনপি প্রধান বলেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হলে অবশ্যই সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হবে এবং তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিতে হবে। সিইসির উদ্দেশে তিনি আরও বলেন, নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা চলবে না। সংলাপে নির্বাচন কমিশনের সংস্কারের জন্য আমাদের দাবির কথা দিয়েছি। সেখানে বলেছি যদি সুষ্ঠু অবাধ নির্বাচন করতে হয়, তাহলে সেনাবাহিনীকে মোতায়েন করতে হবে। আজ নির্বাচন কমিশনার কেন বলে সেনাবাহিনী মোতায়েন হবে না, ইভিএম হবে। তার মানে সরকার যা বলছে তাই তারা করতে চায়। দেশের মানুষ পরিবর্তন চায়, আওয়ামী লীগের হাত থেকে মুক্তি পেতে চায়। এজন্য নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ জোর করে
প্রধান বিচারপতিকে জোর করে পদত্যাগ করানো হয়েছে অভিযোগ করে খালেদা জিয়া বলেন, দেশে বিচার বলে কিছু নেই। প্রধান বিচারপতিকে পর্যন্ত জোর করে অসুস্থ বানিয়ে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এরপর বিদেশে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার লোক পাঠিয়ে প্রধান বিচারপতিকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। কারণ, প্রধান বিচারপতি সত্য কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, সরকার নিম্ন আদালতের ওপর হস্তক্ষেপ করছে। এছাড়া উচ্চ আদালতের ওপরও নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে এ কারণেই তাকে বিদায় করা হলো।
রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে হবে
চলমান রো?হিঙ্গা সমস্যাকে দেশের জাতীয় সমস্যা বলে উল্লেখ করেন তিনি। রোহিঙ্গাদের মানবিক কারণে আশ্রয় দেয়া হয়েছে দাবি করে খালেদা জিয়া বলেন, আমি আন্তর্জাতিক সংস্থা ও রাষ্ট্রগুলোর কাছে বলবো আপনারা অবিলম্বে মায়ানমারে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করুন। কারণ তারা বাংলাদেশের না মায়ানমারের নাগরিক। এ সময় তিনি রোহিঙ্গাদের ত্রাণ দিতে যাওয়া এবং আসার পথে সরকারি দলের নেতাকর্মীরা গাড়িবহরে হামলা করেছে বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, যাওয়ার দিন ফেনীতে আমাদের নেতাকর্মী ও সাংবাদিকদের গাড়িতে হামলা হলো। আসার দিন বাসে বোমা মেরে আগুন দিল। বিএনপি নয়, বাসে আগুন দেয় আওয়ামী লীগ। কিন্তু তারা মামলা দিল আমাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাসহ সব নেতাকর্মীর অবিলম্বে মুক্তি দাবি করেন।
মামলা দিয়ে হয়রানি
খালেদা জিয়ার তার বক্তব্যে বলেন, সরকার অঘোষিত বাকশাল কায়েম করেছে। কেউ তাদের বিরুদ্ধে কথা বললেই তাকে তুলে নেয়া হয়, গুম করা হয়। জেলখানা বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের দিয়ে ভরে রাখা হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, আমাদের ছেলেরা অন্যায় না করলেও তাদের গ্রেফতার করে কারাগারে নেয়া হয়। গুম করা হয়। এমনকি থানায় নিয়ে তাদের পায়ে গুলি করা হয়। অনেক নেতাকর্মীদের পঙ্গু করা হয়েছে। সারাদেশে নেতাদের নামে মামলা দিয়ে হয়রানি করছে। তিনি বিএনপি নেতাদের নামে মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানান।
সরকারের দুর্নীতির ফিরিস্তি
খালেদা জিয়া বলেন, আগে কখনো শুনিনি আমাদের দেশের মানুষ সুইস ব্যাংকে টাকা পাঠিয়েছে। কিন্তু জানা গেল ২০১৫ সালে মাত্র এক বছরে পাঁচ হাজার কোটি টাকা সেখানে পাচার হয়েছে। গত ১০ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে। আর এই ১০ বছরে সাড়ে চার লাখ কোটি টাকার বেশি বিদেশে পাচার হয়েছে। এটা আমাদের হিসাবে নয়, আমেরিকার জিএফআই নামের গবেষণা প্রতিষ্ঠানের হিসাবে। বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, আজ প্রতি পদে পদে দুর্নীতি। সরকার উন্নয়নের কথা বলে উন্নয়নের নামে লুটপাট করছে, দুর্নীতি করছে। ডিজিটাল বাংলাদেশে করার নামে বিশাল দুর্নীতি হচ্ছে। কারসাজি করে বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা পাচার হয়েছে ৮০০ কোটি টাকা। এগুলোর বিচার হয় না।
দেশের স্বার্থে এক হতে হবে
দেশ রক্ষার জন্য জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, বহুদলীয় গণতন্ত্রে মত ও পথের পার্থক্য থাকবে। কিন্তু দেশ ও জনগণের স্বার্থে এক হতে হবে। আমরা জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছি। আসুন দেশের স্বার্থে এক হয়ে কাজ করি। এই কাজ করলেই দেশের উন্নয়ন ও মানুষের কল্যাণ সম্ভব। খালেদা জিয়া বলেন, জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হবে। এজন্য মানুষকে ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে।
কেন বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানো হচ্ছে?
খালেদা জিয়া বলেন, এ সরকার এ দেশটাকে শেষ করে দিয়েছে। ধ্বংস করে দিয়েছে। এ সরকার ২০০৮ সালে কথা দিয়েছিল ১০ টাকা কেজি চাল খাওয়াবে। আজ ৭০ টাকা কেজি চাল খাচ্ছে কেন মানুষ। তিনি বলেন, তরিতরকারি, সবজির দাম ৭০ টাকার নিচে নয়। পিয়াজ ১০০ টাকা পর্যন্ত চলে গেছে। এ দুরবস্থায় মানুষ কী করে জীবনযাপন করবে। প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম জনগণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে।
ক্ষমতায় গেলে যা করবে বিএনপি
খালেদা জিয়া বলেন, আমরা ভিশন ২০৩০ ঘোষণা করেছি। সেখানে আমরা বেশ কিছু বিষয়ের কথা বলেছি। সামাজিক উন্নয়ন, ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা, জনগণের ক্ষমতায়নসহ বেশ কিছু বিষয় উল্লেখ আছে। আমরা এক বছরের বেশি বেকার থাকলে তাদের জন্য বেকার ভাতা, সবার জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা, পর্যায়ক্রমে স্বাস্থ্য বীমা চালু, কম মূল্যে কৃষি পণ্য দেয়ার পাশাপাশি বেশি মূল্যে কৃষকের কাছ থেকে পণ্য কিনবো, দেশের গরিব ও বন্যা ?দুর্গত কৃষকদের কৃষি ঋণ বিতরণ করবো, বাজারমূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ানো হবে। তিনি সরকারি চাকরিজীবীদের উদ্দেশে বলেন, ‘সরকার বলছে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে আপনাদের অনেকের চাকরি থাকবে না। আমরা আপনাদের নিশ্চয়তা দিচ্ছি আমরা কাউকে চাকরি থেকে সরাবো না। মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রমোশন দেয়া হবে।
সরকারকে অভয় দিলেন খালেদা
বিএনপি সংঘর্ষের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না দাবি করে খালেদা জিয়া বলেন, আমরা রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনবো। কার্যকর সংসদ দেখতে চাই। বর্তমানে যা আছে এটা সংসদ না। এই সরকার ও সংসদ অবৈধ। কারণ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি কোন নির্বাচন হয়নি। খালেদা জিয়া সরকারি দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, আমরা আপনাদের মতো ধরবো, মারবো না। আমরা আপনাদের শুদ্ধ করবো। আপনারা যে এই হত্যা, গুম, নির্যাতন করছেন এটা ঠিক না। আমরা সত্যিকারের মানুষ বানাবো আপনাদের। সরকারের অন্যায়, অত্যাচারের জন্য ক্ষমা করে দেয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা বলেছি আপনাদের ক্ষমা করে দিয়েছি। কিন্তু মানুষ তো ভুলেনি।
সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, খালেদা জিয়া ছাড়া আগামীতে দেশে কোন নির্বাচন হবে না, হতে দেয়া হবে না। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, জনগণ এর বিচার করবে। যারা দেশের টাকা বিদেশে পাচার করছে তাদেরকেও একদিন জনতার আদালতে দাঁড় করাবে এদেশের জনগণ।
সমাবেশে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ বলেন, দেশের প্রধান একটি রাজনৈতিক দলকে ২৩টি শর্তে সমাবেশ করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। এতে প্রমাণ হয় দেশে গণতন্ত্র নেই। প্রধান বিচারপতি দেশের গণতন্ত্র এবং বিচার বিভাগ নিয়ে কথা বলায় সরকারের আক্রোশে পড়েছেন। তাকে জোর করে পদত্যাগ করানো হয়েছে। সরকার নিজের হাতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, জনগণ আগামীতে নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চায়।
স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, যারা খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে বাইরে রেখে নির্বাচন করার চিন্তা করছেন, তাদের বলবো সেই নির্বাচন এ দেশে হতে দেয়া হবে না। যারা বলে বিএনপির জনসমর্থন আছে কিন্তু সংগঠন নেই তাদের বলবো আজকের জনসভা দেখেন। বাধা দেয়ার পরও কিভাবে মানুষ জনসভায় অংশ নিয়েছে।
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, আগামী ২০১৮ সাল হবে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপির বিজয়ের মাস। শেখ হাসিনার নেতৃত্ব আর কোন নির্বাচন হবে না। খালেদা জিয়ার রূপরেখা অনুযায়ী নির্বাচন হবে।