গাজীপুর প্রতিদিন ডেস্ক : দেশের বিনিয়োগে চলছে স্থবিরতা। কমেছে ঋণের প্রবৃদ্ধি। এ জন্য ঋণের উচ্চ সুদহারকে দায়ী করছেন ব্যবসায়ী, বিশ্লেষক ও সংশ্লিষ্টরা। তাই অর্থনীতির গতিধারা ঠিক রাখতে সুদহার এক অঙ্কে নামানোর নির্দেশনা দিয়েছে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কঠোর হুঁশিয়ারি দেন প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী। কিন্তু কারও নির্দেশনাই আমলে নিচ্ছে না ব্যাংকগুলো।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একদিকে চলছে ব্যাংকের আর্থিক সঙ্কট। দিনদিন ঋণের চাহিদাও বেড়ে চলেছে। এ ছাড়া খেলাপি বেড়ে যাওয়ায় নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণ করতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে নগদ টাকার সঙ্কটে রয়েছে ব্যাংকগুলো। সুদহার কমাতে সরকারি উদ্যোগ ও ব্যাংকারদের নানামুখী তৎপরতায়ও কাজে আসছে না হু হু করে বেড়েই চলছে সুদহার। এটি বিনিয়োগের জন্য শুভকর নয়। এ প্রবণতায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বিনিয়োগে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, দেশের ৫৭টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে গত মে শেষে ৩১ ব্যাংকের ঋণের সুদহার দুই অঙ্ক ছাড়িয়েছে। বাকি অধিকাংশ ব্যাংকেই দুই অঙ্ক ছুঁই ছুঁই। তবে একক ঋণ হিসেবে ক্ষেত্রবিশেষ কোনো কোনো ব্যাংকের সুদহার সর্বোচ্চ ১৬ থেকে ১৭ শতাংশে পৌঁছে গেছে।
সর্বশেষ গত ২০ মে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ একটি সার্কলার জারি করে। এতে বলা হয়, যেসব ব্যাংক ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনতে পারবে না; ওই সব ব্যাংকের সরকারি আমানত রাখা হবে না। প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীও একাধিকবার সুদহার কমিয়ে আনতে বলেছেন।
গত ১৪ জুন ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ব্যাংকের যে সমস্যাটা, আমরা সবসময় চেষ্টা করেছি যেন সিঙ্গেল ডিজিটে থাকে। আর এ সিঙ্গেল ডিজিটে রাখার জন্য আমরা কতকগুলো সুবিধাও দিলাম। কিন্তু অনেক বেসরকারি ব্যাংক সেটা মানেনি। এবারের বাজেটে সেটা বলাই আছে, নির্দেশনাও আছে। এ ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। তাদের এ নিয়মটা মেনে চলতে হবে যেন ঋণটা সিঙ্গেল ডিজিটে হয়। কোনোমতেই যেন ডাবল ডিজিটে না যায়।
এর আগে বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তাদের চাপে সরকারি তহবিলের ৫০ ভাগ অর্থ বেসরকারি ব্যাংকে রাখার নির্দেশনা দেয় সরকার। আগে এ হার ছিল ২৫ ভাগ। অর্থাৎ সরকারি তহবিলের অর্থ ৭৫ ভাগ থাকতো সরকারি ব্যাংকে এবং বাকি ২৫ ভাগ রাখা যেত বেসরকারি ব্যাংকে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকে রাখা ব্যাংকগুলোর নগদ জমা সংরক্ষণ (ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও বা সিআরআর) এক শতাংশ কমিয়ে সাড়ে পাঁচ শতাংশ করা এবং এডিআর সমন্বয়ের সময়সীমা বাড়িয়ে ২০১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর বর্ধিত করা হয়েছে। তারপরও ঋণের সুদহার কমছে না।
তারল্য ব্যবস্থাপনার ওপর বাড়তি চাপকে কেন্দ্র করে সুদহার বাড়তে থাকায় তা নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত ৩০ মে এক নির্দেশনায় বলা হয়, ব্যাংকগুলো বিভিন্ন প্রকার ঋণের সুদহার ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি করছে। ঋণের সুদহার অযৌক্তিক মাত্রায় বৃদ্ধি করা হচ্ছে, যা উদ্বেগজনক। তাই সুদহার যৌক্তিক পর্যায়ে নির্ধারণ করতে ভোক্তা ঋণ ও ক্রেডিট কার্ড ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে স্প্রেড ৪ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। আগে যা ৫ শতাংশ ছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ মে মাসের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ঋণের সুদহার দুই অঙ্কে রয়েছে ৩১ ব্যাংকের। এর মধ্যে বিদেশি স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের ঋণের সুদহার ১০ দশমিক ০৩ শতাংশ, কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন ১০ দশমিক ১১ শতাংশ এবং ব্যাংক আল ফালাহ ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সিটি ব্যাংকের ১০ দশমিক ৯৮ শতাংশ, আইএফআইসি ১১ দশমিক ৮৭ শতাংশ, ইস্টার্নে ১০ দশমিক ৯৫ শতাংশ, এনসিসির ১০ দশমিক ৩৪ শতাংশ, প্রাইম ব্যাংক ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ, সাউথ ইস্ট ১০ দশমিক ০৬ শতাংশ, ঢাকা ব্যাংকের ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ, স্যোসাল ইসলামী ব্যাংকের ১০ দশমিক ৫১ শতাংশ, ডাচ্-বাংলায় ১০ দশমিক ৩২ শতাংশ, স্ট্যান্ডার্ডে ১১ দশমিক ০৪ শতাংশ, ওয়ান ব্যাংক ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ, এক্সিমের ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশ, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ১০ দশমিক ৭১ শতাংশ, প্রিমিয়ারে ১১ দশমিক ২৭ শতাংশ, ফার্স্ট সিকিউরিটিজ ইসলামী ব্যাংকের ১১ দশমিক ৫৫ শতাংশ, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ১০ দশমিক ৮৮ শতাংশ, যমুনা ব্যাংকের ১১ দশমিক ১৩ শতাংশ, ব্র্যাক ব্যাংক ১২ দশমিক ৪৯ শতাংশ, এনআরবি কমাশিয়াল ব্যাংক ১৩ দশমিক ২৪ শতাংশ, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ১১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, মেঘনা ১১ দশমিক ৬ শতাংশ, মিডল্যান্ড ব্যাংক ১২ দশমিক ২৭ শতাংশ, পদ্ম ব্যাংক (সাবেক ফামার্স ব্যাংক) ১১ দশমিক ৮৯ শতাংশ, ইউনিয়ন ব্যাংক ১২ দশমিক ১৪ শতাংশ, এনআরবি ব্যাংক ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ, এরআরবি গ্লোবাল ১৩ দশমিক ৬২ শতাংশ ও মধুমতি ব্যাংক ১২ দশমিক ৫৮ শতাংশ।
এ বিষয়ে ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, আমানত সঙ্কটের কারণে সুদহার কাঙিক্ষত পর্যায়ে নামানো যাচ্ছে না।’
সরকার প্রধানের নির্দেশনা সত্ত্বেও সুদহার না কমে উল্টো বাড়বে এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সিঙ্গেল ডিজিটে সুদহার নামিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। অনেক ক্ষেত্রে কমানোও হয়েছে। তবে বাস্তবিক কারণে পুরোপুরি কমানো যায়নি। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে আমানতের সঙ্কট। এছাড়া খেলাপি ঋণ বাড়ায় প্রভিশন রাখতে গিয়ে অর্থ সঙ্কটে পড়ছে। সব মিলিয়ে সুদহার কমাতে সমস্যা হচ্ছে। তবে চেষ্টা চলছে তারল্য সঙ্কট কমলে সুদহার কমে যাবে।